Wednesday, February 13, 2019

ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক, আজ বসন্ত


‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে/তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে/কোরো না বিড়ম্বিত তারে-’ এভাবেই ঋতুরাজ বসন্তের বন্দনা করেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বসন্ত উপলব্ধি করেছেন এভাবে ফুল ফুটুক আর না ফুটুক/আজ বসন্ত।’ হ্যাঁ, গাছের শাখার শাখায় রঙিন ফুলের পসরা সাজিয়ে, ঝরিয়ে দিয়ে মলিন পাতার রাশি, আজ বুধবার পহেলা ফাল্গ–ন, আজ বসন্তের প্রথম দিন।

ছয় ঋতুর বাংলায় বসন্তের রাজত্বে প্রকৃতি সিদ্ধ হবে। ঋতুরাজ বসন্তের বর্ণনা কোনো রং-তুলির আঁচড়ে শেষ হওয়া নয়। কোনো কবি-সাহিত্যিক বসন্তের রূপের বর্ণনায় নিজেকে তৃপ্ত করতে পারেন না। তবুও বসন্ত বন্দনায় প্রকৃতিপ্রেমীদের চেষ্টার যেন শেষ নেই। গাছে গাছে ফুল ফুটুক আর নাই-বা ফুটুক, বসন্ত তার নিজস্ব রূপ মেলে ধরবেই। ফাগুনের আগুনে, মন রাঙিয়ে বাঙালি তার দীপ্ত চেতনায় উজ্জীবিত হবে। বাঙালির ইতিহাস আবেগের। এ আবেগ যেমন মানুষে মানুষে ভালোবাসার, তেমনি মানুষের সঙ্গে প্রকৃতিরও বটে। দিন-ক্ষণ গুনে গুনে বসন্ত বরণের অপেক্ষায় থাকে বাঙালি।

কালের পরিক্রমায় বসন্ত বরণ আজ বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম উৎসব। আবাল-বৃদ্ধা, তরুণ-তরুণী বসন্ত উন্মাদনায় মেতে উঠবে। শীতকে বিদায় জানানোর মধ্য দিয়েই বসন্ত বরণে চলবে ধুম আয়োজন। শীত চলে যায় রিক্ত হস্তে, আর বসন্ত আসে ফুলের ডালা সাজিয়ে। বাসন্তী ফুলের পরশ আর সৌরভে কেটে যাবে শীতের জরাজীর্ণ।

বসন্তকে সামনে রেখে গ্রামবাংলায় মেলা, সার্কাসসহ নানা বাঙালি আয়োজনের সমারোহ থাকবে। ভালোবাসার মানুষ মন রাঙাবে বাসন্তী রঙেই। শীতের সঙ্গে তুলনা করে চলে বসন্তকালের পিঠা উৎসবও। তরুণীরা বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে প্রকৃতির কোলে নিজেকে সপে দিতে চাইবে। অন্যদিকে বসন্তের উদাস হাওয়ায় তরুণরা নিজেকে প্রকাশ করার মধ্যদিয়ে প্রকৃতির মন কাড়তে চাইবে। বসন্ত যেন মানব মন আর প্রকৃতির রূপ প্রকাশের লীলা-খেলা। বসন্ত উৎসব কেবল গ্রামীণ আয়োজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। শহুরে মানুষের কাছেও বসন্তের আবেদন ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। বিশেষ করে শহরের তরুণ-তরুণীরা বসন্ত বরণে দিনভর ব্যস্ত থাকে। ফুলে ফুলে ভরে যাবে তরুণীর চুলের খোঁপা। শহরের বিভিন্ন জায়গায় বসবে খাবারের মেলা। এ দিন দর্শনীয় স্থানগুলোয় মানুষের পদচারণায় যেন তিল ধরার ঠাঁই থাকে না।

প্রকৃতির মতোই শিল্প-সাহিত্য এমনকি রাজনীতিতেও বসন্ত বাঙালি জীবনে তাৎপর্যময়। এ বসন্তেই ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে বাঙালির স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়েছিল। বসন্তেই বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের শুরু। বসন্তের আগমনবার্তা নিয়ে আসে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ ও ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। রাজধানীতে ১৪০১ বঙ্গাব্দে প্রথম ‘বসন্ত উৎসব’ উদযাপন করার রীতি চালু হয়। সেই থেকে প্রতিবছর জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ এ আয়োজন করে আসছে। রাজধানীতে এ বছরের বসন্ত উৎসবের অনুষ্ঠানমালা আরো ব্যাপকতা লাভ করেছে।

পহেলা ফাল্গ–নে আজ রাজধানীতে রয়েছে ব্যাপক আয়োজন। চারটি স্থানে আয়োজন করা হয়েছে ‘বসন্ত উৎসব’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় দিনব্যাপী এবং ধানমণ্ডির রবীন্দ্রসরোবর মঞ্চ, লক্ষ্মীবাজারের বাহাদুরশাহ পার্ক ও উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের রবীন্দ্র সরণির উন্মুক্ত মঞ্চে বিকাল থেকে রাত অবধি বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে। এ উৎসবে যন্ত্রসঙ্গীত, বসন্তকথন পর্ব, প্রীতিবন্ধনী, আবির বিনিময়, একক আবৃত্তি, দলীয় আবৃত্তি, একক সঙ্গীত, দলীয় সঙ্গীত, দলীয় নৃত্য, আদিবাসীদের ও শিশু-কিশোরদের বিশেষ পরিবেশনা থাকবে। দেশের অগ্রগণ্য দল ও বরেণ্য শিল্পীরা এ অনুষ্ঠানমালায় অংশ নেবেন।

শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করেছে ৩ দিনব্যাপী ‘বসন্ত উৎসব’। একাডেমি প্রাঙ্গণে নন্দনমঞ্চে আয়োজিত অনুষ্ঠানমালায় থাকবে সঙ্গীত, নৃত্য, আবৃত্তি। প্রতিদিন অনুষ্ঠান শুরু হবে বিকাল সাড়ে ৫টায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘শহরকেন্দ্রিক বসন্ত উৎসবের সবচেয়ে বড় ঢল নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কলাভবনের সামনে ঐতিহাসিক বটতলায় সমগীত সাংস্কৃতিক প্রাঙ্গণ ঢাকা শাখার আয়োজনে হয় বসন্ত বরণ উৎসব। চারুকলায় জাতীয় বসন্ত উদযাপন কমিটি বসন্ত বরণের উৎসব করে। যার বহুমাত্রিক ব্যাপকতা দিনদিন বাড়ছে। যার স্পর্শ ছুঁইয়ে যায় বইমেলাতেও।

বসন্ত উদযাপন পরিষদের আয়োজক কমিটির অন্যতম সদস্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মানজারুল ইসলাম চৌধুরী সুইট বলেন, ‘শহরে বসন্ত উদযাপন ভিন্নমাত্রা নিয়ে এসেছে। সকাল থেকেই আজ মানুষের ঢল নামবে। আমরা প্রতি বছর এই উৎসবটির আয়োজন করি। ঋতুরাজকে স্বাগত জানাতে প্রকৃতির আজ এত বর্ণিল সাজ। বসন্তের এই আগমনে প্রকৃতির সঙ্গে তরুণ হৃদয়েও দোলা দেয়। যে যে বয়সেই থাকুক না কেন বসন্ত উৎসব হচ্ছে তারুণ্যের উৎসব।’

Related Posts: